২০২৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য ছিল এক দুঃসহ বছর। আগস্টে ভারতের পানি প্রবাহে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং প্রাণহানির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির বোঝা বেড়ে যায়। এর আগে এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে জনজীবন অচল হয়ে পড়ে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় সরকার। মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে খুলনা বিভাগের গ্রামীণ জনপদে। নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, নিরাপদ পানির সংকট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেখানে মানুষের জীবনকে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে। খুলনায় কাজ করার অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট বোঝা যায়, কীভাবে প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে।
খুলনার বানিশান্তা ইউনিয়নের মতো এলাকা সুন্দরবনের কাছাকাছি হলেও দুর্যোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বন্যায় কৃষিকাজ প্রায় অচল হয়ে যায়, আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। যশোরের কেশবপুরে প্রতিবছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তীব্র জলাবদ্ধতায় মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়। শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, কৃষিজমি নষ্ট হয় এবং রাস্তা-ঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শ্রীমান্তকাঠি গ্রামে সুপেয় পানির জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয় স্থানীয়দের, আর অসংখ্য পরিবার নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
এ ছাড়া নড়াইলের মাইজপাড়ায় জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী সমস্যা। এর ফলে সাপের উপদ্রব বাড়ছে, পয়ঃনিষ্কাশন ভেঙে পড়েছে, আর নারী-শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে। অনেকেই রাস্তায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, তবুও দুর্ভোগের শেষ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরে অতিরিক্ত আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ও তাপজনিত রোগের কারণে। অপরদিকে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সতর্ক করেছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ১৪.৫ মিলিয়ন অতিরিক্ত মৃত্যু এবং ১২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। টেকসই বাঁধ ও আধুনিক সেচব্যবস্থা গড়ে তোলা, সুপেয় পানির উৎস বাড়ানো, জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রচলন ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করলেই খুলনাসহ বাংলাদেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব থেকে অনেকটা রক্ষা করা সম্ভব হবে।